রান্না ঘরটির মাথার উপর দিয়ে ধোঁয়া একেবেঁকে উঠে যায় আকাশে। দুটো ছেলে ধোঁয়ার উদগিরণ লক্ষ করে। কি কারণে ওদের চোখের পলক পড়ে না তা বলা যায় না। ধোঁয়ার সঙ্গে আসলে ওদের সম্পর্ক কি? টিলার ওপর ঘরগুলো কেমন ভূতুরে ছবির মত স্থির হয়ে আছে। চারপাশটা রোদে জ্বলে যাচ্ছে। একটা দাঁড় কাক গর্জন গাছের মাথায় কা-কা রব করছে। ছেলে দুটোর পাশাপশি একটা কঙ্কালসার কুকুরও বসে আছে। এদেরকে দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন যাবৎ এরা পেট পুরে খেতে পায় না।
বাড়ির গৃহিণীর ভাত হলে ছেলে দুটো ফেন নেবে। সকাল থেকে এসে বসে আছে ওরা। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলেছে মাসি তোদের ভাত হইলে আমদেরকে ফেনটুকু দিসতো। কেনরে তোরা ফেন চাচ্ছিস, তোরা কিছু খাসনি?
না মাসি আমরা কিচু নাই খাইলাম, বাপে কদিন কাম করতে পারে নাই আর ঠাকুর দা ঘরে না খায়ে কনে বইসে আছে। পাঁচ বছরের ছেলেটির নাম-নুনু। আর ছোট ছেলেটির নাম কী গৃহকত্রর্ীর জানা হয় না। ছোট ছেলেটি একেবারে উদোম। আর বড় ছেলেটির পরনে একটুকরো পুরানো কাপড়। কুচকুচে কালো দেহে ময়লার আসত্দর পড়ে আছে। ছোট ছেলেটি ক্ষুধায় কাৎরাচ্ছে। নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে জিভ দিয়ে সেগুলো সে আবার চেটে চেটে খাচ্ছে। বাড়ির গৃহকত্রর্ী তাকিয়ে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন তারপর নিজের কাজে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে যেখানে সে ময়লা ফেলে গিয়েছে সেখানে বড় ছেলেটা ময়লা ঘেটে কলার ভুগলির কিয়দংশ বের করে। তারপর নিজে এক কামড় বসিয়ে ভাইকে এক কামড় দিয়ে কচ কচ করে চিবুতে থাকে। ওদের মলিন চোখ জোড়া এখন বেশ চক চক করতে থাকে। গৃহকত্রর্ী আবার ফিরে আসে। তার হাতে একটা মগ। আরেকটা বাটিতে সামান্য আটা ভাজা। এগিয়ে দেয় বড় ছেলেটার দিকে। খুশিতে বড় ছেলেটার চোখ উপচে হাসি ঝরে। বাতাসে আটা ভাজার ঘ্রাণ মৌ মৌ করে। ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে বদনায় রাখা পানি নিয়ে আসে। বদনার পানিতে চুমুক দিয়ে তারপর চায়ের মধ্যে আটাগুলো ফেলে দেয়। তারপর ছোট্ট একটা চুমুক দেয় সিলভারের মগে। ছোট ছেলেটা চোখজোড়া চিলের মত নিক্ষেপ করে রাখে বড় ছেলেটার দিকে। বড় ছেলেটা এবার ছোট ছেলেটার মুখে মগটি ধরে। আর ছেলেটা চুক চুক করে হরিণের বাচ্চার মত খেতে থাকে।
চারপাশে আর কোন সাড়া শব্দ নেই। রতনপুর চা বাগানের অটলবুড়া আর ঘণ্টা পেটায় না। ঘণ্টা দিলে বোঝা যেত এখন কত বাজে। হয়ত বেলা দশটা এগারটা হবে। মাধববুড়া উঠোনের উপর গড়াতে থাকে। এত খিদে সে সহ্য করতে পারছে না। রোদের ঝিলিকটাকে মনে হচ্ছে পানির সরোবর হাম হাম করে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মাটিও পাচ্ছে না। মাটি পেলে মাটি খেত। মাটিও বেশ মজা। মাটি খেয়ে তারপর পানি খেলে পেটের জ্বলুনিটা কমে। বাবুলালটা কাজে গিয়েছে। অসুখে ভুগছে সে। নাতি দুটো কোথায় গেছে কে জানে। চাল ডালের যে দাম বেড়েছে। এতে বোধহয় চা বাগানের মানুষগুলোকে না খেয়ে মরতে হবে। চা বাগানটা চালু থাকলেও এক কথা ছিল কোম্পানিটা ছোটলোকের ঘরে ছোটলোক। রাজধানী শহরে বসে কেউ কী বাগান চালাতে পারে? বাগানের দেখ ভালোর জন্য মাঝে মধ্যে বাগানে আসতে হয়। না হলে তো এখানে হরিলুট হবেই হবে। অনেকে অবশ্য বাগান ছেড়ে চলে গেছে। কি আর করবে না গিয়ে এখানে বসে থাকলে লাকড়ি বেঁচে আর কয় দিন। বাবুলাল আজকে অনেক দিন পর গেছে লাকড়ি সংগ্রহ করতে। লাকড়ি বেঁচে যা হোক কিছু পেটে দেবার জন্য সে আনবে। নাতি দুটো যাবার সময় বলে গেছে বাবুর বাসা থেকে ফেন চেয়ে আনবে, সে আশাতে সে রোদের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পেটের মধ্যে খামছে ধরেছে হিংস্র কোন জন্তু। ইচ্ছে করছে পেট চিড়ে ফালা ফালা করতে। হাঁটার শক্তি নেই মাধব বুড়োর। আকাশটা এমন করে জ্বলছে কেন! কেইবা জানে। একটু মেঘ করত ভালো হত। মেঘ হলে হা করে পানি খাওয়া যেত। এখন উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে পানি খাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। পা দুটো এত জমে গেছে যে নড়াচড়া করবার শক্তি নেই। বাবুলালের বউটা থাকলে না হয় কিছু একটা চাওয়া যেত। চাইলেই যে সে দিত তা নয়। অনেক সময় মুখ ঝামটা দিত। বলত, মরার বুড়া মইরছিস নাই কিল্লাই ? হাড় মাংস সব খেয়ে কনে তারপর মরবি না?
মাধববুড়ো কিছুই বলত না। যদি তেড়ে মারতে আসে, তবে এই দেহে তাকে ঠেকাতে পারবে না। কাজেই চুপচাপ থাকা ভাল। তবে সব সময় খেঁকিয়ে উঠত না, মাঝে মধ্যে সে এটা ওটা দিত। এখন সে আশায় গুড়েবালি। মালতি এখন নেপচুন বাগানে। হডিয়া ওকে নিয়ে ভেগেছে। দুই ছেলের মা এভাবে চলে যাবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু বাগানটা তখন চলত। এখন পুরোপুরি বন্ধ। অনেকেই এটা সেটা বিক্রি করতে শুরু করেছে। মাধবের উঠোন থেকে ফ্যাক্টরির ড্রায়ারের চিমনিটা দেখা যায়। কী করবে মানুষ। আশায় আছে হয়ত বাগানটা আবার চালু হবে। রতনপুর ছেড়ে যেতে সবারই কষ্ট হবে। আর তার জন্যই মনে হয় কেউ বাগানটা ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। সূর্যটা গনগনে হয়ে উঠেছে। মাটিও উত্তপ্ত। উঠোনটা শক্ত মাটিতে ঠাসা। কোথাও মাটির ঢেলা-টেলা দেখা যাচ্ছে না। এ দিকে কাছে পিঠে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মাধবের ইচ্ছে হলো জোরে একটা চিৎকার দেয়। কিন্তু শক্তিহীন গলাটা কেমন খড়খড়ে আওয়াজ তুলে থেমে গেল। আর গলাটা থেমে যেতেই সমসত্দ শরীর দাপিয়ে কাশি উঠে এল। ধনুকের মত বাঁকা হয়ে মাধব কাশতে শুরু করল। মাধবের কাশির দমকে একটা গোবরে শালিক ময়লা ঘাটা বন্ধ করে তার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। উঠোনের অনতিদূরে কিসের একটা মাচাং ছিল এখন আর বোঝা যায় না। তবে ওখানে যে একটা শুকনো লতানো উদ্ভিদ ছিল তা এখনো তার শুকনো মরা দেহ প্রমাণ দিচ্ছে। ওটার তলায় গেলে মাটির ঢেলা পাওয়া যেতে পারে।
মাটির ঢেলা আনতে গেলে মাধবকে এখনই গড়াতে শুরু করতে হবে। গড়াতে শুরু করার পূর্বে মাধবের চিনত্দায় একটা আটার রুটি আর এক থালা লবণ ছিটানো চা'র ছবি উঠে এল। আহ! কি তৃপ্তি! সেই অদ্ভুত তৃপ্তিকর দিনের ছবি মাধবের চোখের সামনে দুলতে লাগল। আর দুলতে লাগল কামিনীবালার মমতায় ভরা মুখখানা। গড়াতে গিয়ে দুই হাত মাটিতে ঘষে গেল। কিছুক্ষণপর ওখানটায় জ্বলতে লাগল। মনে হলো কে যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। তবুও দমল না মাধব। একটার পর একটা গড়ান দিয়ে সে এগিয়ে গেল মাচাঙের কিনারটায়। শুকনো লাউয়ের লতার গোড়ায় কয়েকটা মাটির ঢেলা সে দেখতে পেল। মাধবের মনটা খুব খুশি হয়ে উঠল। ছোট একটা ঢেলা কালচে মত রং সে নাকের কাছে নিয়ে শুকতে লাগল। না, তেমন গন্ধ নাকে এল না। এবার সে ছানিপড়া চোখ দুটো মেলে তাকাল। না, রঙটা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। যা হবে হোক মাধব এবার আর দেরি করতে চাইলো না। এক কামড় বসিয়ে দিল শুকনো ঢেলার মত মনে হওয়া গরুর গোবরে। না, স্বাদটা একদম ভিন্ন রকমের। মাটির যে স্বাদ সে স্বাদ পাওয়া গেল না। সে মুখ থেকে থু থু করে সব ফেলে দিল। আরেকটা ঢেলা খোঁজার জন্য ইতি উতি তাকাতে লাগল। কিছুক্ষণ খুঁজে মিলল একটা। এবার মাধব দাঁতের পেষণে কেটে নিল মাটির শরীর। তারপর চিবুতে লাগল বুভূক্ষের মত। বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে এবার পানির তেষ্টায় বুক ফেটে যাবার যোগাড় হল।
এমন সময় আঙিনার বাইরে কার গলা শুনতে পেল মাধব। মাধব দা কি কইরছিস? মাধব গলা চিনতে না পেরে বলল, কে লাগিস? দাদা আমিই না। এই আমিই না যে কে তা আর মাধবের জানা হয় না। লোকটা যা বলল তার ভাবার্থ এই। অটলবুড়া মারা গেছে। না খেতে পেয়ে আর কদিন টেকা যায় বল। মাধব ভাবল বেশ হয়েছে অটল বুড়া মরেছে। মরে গিয়ে বেচারা বেঁচেছে। বেঁচে থাকলে না খেতে পেয়ে শুটকি হতে হত। সে যদি মরত আর ভাল হতো। সে মরছে না কেন? হে ভগবান আমকে লিয়ে যা। আমি আর নাই পারি। কিরকম কইরে আমি থাইকব। আমকে বইলে দে ভগবান, আমি আর নাই পাইরছি। তার নাতি দুটো এখনো ফিরছে না কেন! আর বাবুলাল! উয়ে মামিগা কী কইরছে এতক্ষণ? নিজর্ীব মরার মত পড়ে থাকে মাধব। ফেন খাওয়ার জন্য মনটা কেমন আইঢাঁই করছে। ভাত কত দিন চোখে দেখে না তার ইয়াত্তা নেই। ভাতের ছবি চোখের ভিতরে ভাসতে থাকে। বুকের পাঁজরের হাড় তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ভেংচি কাটছে। অনেকটা পোড়া কাঠের মত দেহখানা। মাংসের বালাই নেই। কি কারণে কে জানে মুখ দিয়ে গোগলা উঠতে থাকে বুড়ো মাধবের। বোবা পশুর মত একটা গো গো শব্দ বেরুতে থাকে মুখ দিয়ে। কিন্তু আশে পাশে কেউ নেই, মাধবের অসহায় শব্দ শুনে তাই কেউ এগিয়ে আসে না। পড়ে থাকে মাধব নিজর্ীব। শুধু শ্বাসটা বোঝা যায়। অনেকক্ষণ পর কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায় সে। শ্লথ পায়ে কে যেন বারান্দায় এসে বসে। অকথ্য গালি গালাজ করতে থাকে। মাধব বুঝতে পারে বাবুলাল এসেছে। বোধহয় কোন কিছু যোগাড় করতে পারেনি, তাই মেজাজটা খঁচে আছে। অথচ সে অনেক আশায় ছিল। সে আশায় গুড়েবালি।
একটুপরেই হল্লা করে নাতি দুটো এল। একটা পলিথিনে ভাতের মার। নুনু নামের ছেলেটা কাছে এগিয়ে এসে বলল, এই বুড়া দেকনা তুরলাই কি আইনলাম? বুড়োর চোখ দুটো চক চক করে ওঠে। আহ! বহুদিন পর ভাতের মার খাবে। শাক ঘেঁচু এসব সেদ্ধ খেতে খেতে পেটে চর জমে গেছে। পলিথিনটা নাকের কাছে নিয়ে শুকতে লাগল বুড়ো মাধব। ছেলে দুটোও অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু হঠাৎ বাজ পাখির মত ছোঁ দিয়ে পলিথিনটা ছিনিয়ে নিল বাবুলাল। দে দে আমকে দে। তুই মইরে যা বুড়া। আর বাঁইচে থাইকে কী করবি? পলিথিনটা মুখের কাছে ধরে বাবুলাল চুক চুক করে খেতে শুরু করল। মাধব একটা অকথ্য গালি দিয়ে ছিনিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু বাবুলালের হাত থেকে ওটা নিতে সক্ষম হল না। বাবুলাল ক্ষিপ্ত হয়ে মাধবের টুটি চেপে ধরল। তুকে আইজকে মাইরে ফেইলব শালারবেটা। নাই মরিস কেনে? মর, মর,মর। মাথাটা ধরে ঝাকাতে থাকে বাবুলাল। ছেলে দুটো চিৎকার করে। বাপে দাদুকে ছাইড়ে দে। কিন্তু বাবুলাল যখন ক্ষানত্দ দিল তখন মাধবের আর সাড়া শব্দ নেই। হাত থেকে ছিটকে পড়েছে ফেনের পুটলাটা। গড়িয়ে পড়ছে শক্ত মাটির বুকে। ওদিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলে দুটো আর বাবুলাল। আর মাধবের গালের কোষ বেয়ে কালচে এক ফোটা রক্ত গাড়িয়ে নামছে। দুপুরটা এক জায়গায় থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মহি মুহাম্মদ
আন্তরিকভাবে যারা গল্প পাঠ করে আমাকে এই আসনে বসিয়েছেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন। যাঁরা মন্তব্য করেছেন তাদের সকলকেই কৃতজ্ঞতা জানাই।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।